অপরাধ বাড়ছে কেন?
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম
রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদবাজি, হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি অপরাধ বাড়ছে। ৫ আগস্ট দেশে একটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। তার মাফিয়া শাসনের প্রধান হাতিয়ার ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হত্যা, গুম, অপহরণসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা করেনি। নবনিযুক্ত আইজিপি পুলিশের অপকর্ম ও অপরাধের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, পুলিশ সব ধরনের অপরাধই করেছে। স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে ভূমিকা পালনকারী পুলিশ বাহিনী সঙ্গতকারণেই ছাত্র-জনতার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। অনেকে আক্রান্ত ও নিহত হয়েছে। অনেকে পালিয়ে গেছে। পুলিশ রাষ্ট্রের এমন এক অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান, যার অবর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা, নাগরিক নিরাপত্তা, শান্তি-কোনো কিছুই ঠিক থাকতে পারে না। ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত পুলিশ সুস্থির হতে পারেনি, দায়িত্ব পালনে পূর্ণ সক্ষম হতে পারেনি। পর্যবেক্ষকদের মতে, আইনশৃঙ্খলার অবনতির এটি একটি বড় কারণ। পুলিশে পুনর্বিন্যাস ও গতি আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে এ ক্ষেত্রে অনেক খানি উন্নতিও হয়েছে। তারপরও আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি ও অপরাধ বৃদ্ধি নাগরিক উদ্বেগের বিশেষ কারণে পরিণত হয়েছে। পুলিশের ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়েছে, আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২০৫টি ডাকাতি, ৪৬৪টি ছিনতাই সংঘটিত হয়েছে। খুনের মামলা হয়েছে ২২৩৭টি। এসময় ঢাকায় খুনের অভিযোগ মামলা হয়েছে ৩৭৯টি, ছিনতাই ও ডাকাতি হয়েছে ৬৫ ও ১৫টি। এছাড়া ঢাকার বাসাবাড়িতে চুরির অভিযোগে মামলা হয়েছে ৩৪০টি। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে অপরাধের সংখ্যা বর্ণিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত। ৫ আগস্ট থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের হাতে অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছে। এইসঙ্গে গুপ্ত হত্যা নতুন উপসর্গ হিসেবে দেখা দিয়েছে। লক্ষ করার বিষয়, এপর্যন্ত গুপ্তহত্যার যারা শিকার হয়েছে, তাদের অন্তত দু’জন শিক্ষার্থী এবং জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, পতিত স্বৈরাচারের দোসররা পরিকল্পিতভাবে এসব গুপ্তহত্যা করে থাকতে পারে। দেশে একটা অরাজক ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করাই তাদের উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনে অপারগতা, নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতাকে দায়ী করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়ী বটে; কিন্তু এককভাবে দায়ী কি? পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আরো বিবিধ কারণ রয়েছে, যা অপরাধ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। তাদের মতে, অর্থনৈতিক দুর্দশা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করে, অপরাধ সংঘটনে যার ভূমিকা প্রধান। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশ এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুরস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদী সরকার অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। অর্থ লুট ও পাচার ছিল তার অভীষ্ট নীতি ও লক্ষ্য। সাড়ে ১৫ বছরে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠন ও পাচার হয়েছে। সরকার প্রধান, তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী এবং অনুগত ব্যবসায়ীরা এই অর্থ চুরি ও পাচার করেছে। চোরতন্ত্রে দেশের দরিদ্র মানুষ হয়েছে আরো দরিদ্র, মধ্যবিত্ত হয়েছে দরিদ্র। বেকারত্ব দুবির্ষহ রূপ নিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ এখন বেকার, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শিক্ষিতরাও রয়েছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের জন্য মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে। অনিশ্চিত জেনেও বাংলাদেশি যুবকরা যখন ইউরোপের পথে সাগরে ডুবে মরে, মালয়েশিয়ার পথে বন-জঙ্গলে না খেয়ে মরে, তখন বুঝা যায়, বেকারত্ব কত ভয়ংকর। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব মানুষকে বিভিন্ন ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ করতে বাধ্য করে। স্বৈর সরকার দারিদ্র্য ও বেকারত্ব মোচনে কর্মসংস্থানের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে লুট ও পাচারের জন্য। শিল্প কারখানা গড়েনি, যাতে বেকারদের কর্মসংস্থান হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে একদিকে পেয়েছে বিপর্যস্ত অর্থনীতি অন্যদিকে পেয়েছে বেকারের একটা বৃহৎ সমাবেশ। যখন মানুষের কাজ থাকে না, তখন যত রকমের অকাজ আছে, সেগুলো করে। তাদের অনেকের অবলম্বন হয় মাদক ও বিভিন্ন রকম অপরাধ। মাদকে দেশ এখন বলতে গেলে সয়লাব। মাদকাসক্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিভিন্ন বয়সী মানুষ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, এমন কি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও বাদ নেই। দেশে মোট মাদকসেবীর সংখ্যা এখন এক কোটির ওপর। মাদকসেবীরা শুধু সেবনেই যুক্ত নেই, মাদক ব্যবসা, মাদক বহন ইত্যাদির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। মাদকাসক্তি এমন এক আসক্তি, যার কারণে অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে মাদকাসক্তরা। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, খুনÑ কোনো কিছুতেই তারা পিছপা হয় না।
সার্বিক অবস্থার এই প্রেক্ষাপটে পুলিশের একক প্রচেষ্টায় অপরাধ দমন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পুলিশের উদ্যম, উদ্যোগ, দায়িত্বশীল ভূমিকা তো থাকবেই, সেইসঙ্গে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করার কার্যকর ব্যবস্থাও থাকতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে এই জায়গায় যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। বিনিয়োগ আনতে হবে, তা কাজে লাগাতে হবে। অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে বিনিয়োগে প্রাধান্য দিতে হবে। আশার কথা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তার সুফল আসতে শুরু করেছে। অর্থনীতিতে এখনো অন্তত পাঁচ রকমের ঝুঁকি রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন। এই ঝুঁকিগুলো কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এমন কোনো নিত্যপণ্য নেই, যার মূল্য ক্রমাগত না বাড়ছে। বিভিন্ন পণ্যের অতিরেক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আগের মতোই সিন্ডিকেট কারসাজি করছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। সরকার কেন সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সরকার পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারছে না। চাঁদাবাজির কারণে ঢাকায় নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে বলে ডিএমপি কমিশনার সম্প্রতি জানিয়েছেন। চাঁদাবাজির কথা অর্থ উপদেষ্টাও বলেছেন। জানিয়েছেন, বাজারে গেলে তিন ধরনের চাঁদাবাজ দেখা যায়: কিছু আগের সরকারের চাঁদাবাজ, কিছু ভবিষ্যৎ সরকারের চাঁদাবাজ, আর কিছু স্থানীয় চাঁদাবাজ। পরিবহনে চাঁদাবাজিটা রুখতে হবে যেকোনো মূল্যে। তাহলে নিত্যপণ্যের মূল্য কমবে। মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আসবে। তাতে তাদের মধ্যে সস্তি আসবে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধি কমবে। ইতোমধ্যে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বাড়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সরকার সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেবে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, বেসরকারি চাকরিজীবীÑ তাদের মহার্ঘ ভাতা কে দেবে? এ দেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া খুব সামান্যÑ মোটা ভাত, মোটা কাপড়, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ছেলে-মেয়ের শিক্ষাÑ এটুকুই। এটা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা
অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া
একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে
তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ
‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর
২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা
ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ
ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত
মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি
আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ
অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না
হাসিনার নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলার পুনঃতদন্ত শুরু
১১ ইউনিটে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা
বাংলাদেশসহ ২০টিরও বেশি দেশ ব্রিকসে আগ্রহী : পুতিনের সহকারী
গেটজ কেলেঙ্কারিতে বিদ্ধ ট্রাম্প
সিরিয়ার পাশে থাকার আশ্বাস জর্ডান ও কাতারের